দারু ভাস্কর্যের অঙ্গরাগ
স্বপনকুমার ঠাকুর
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার শিল্পীরা মাটি পাথর ধাতু আর কাঠ দিয়ে মূর্তি বা বিগ্রহ তৈরি করে আসছেন।মাটির চেয়ে কাঠ অনেক টেকসই বলে দারুভাস্কর্য অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।শুধু মূর্তি নয়,চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাঠের তৈরি রাজপ্রাসাদ ছিল ।ঋগবেদে শতারিত্র নামে শত দাঁড় বিশিষ্ট কাঠের নৌকার কথা আছে।বাড়িঘর চণ্ডীমণ্ডপ রথ মূর্তি ইত্যাদির দারুভাস্কর্য আমাদের ঐতিয্য।গবেষকরা বলেন ভারহুত সাঁচী বুদ্ধগয়া ইত্যাদির গায়ে যে অনুপম খোদাই চিত্র রয়েছে তা দারুভাস্কর্য থেকে গৃহীত হয়েছে।বাংলায় এই দারু ভাস্কর্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ছুতোর বা সূত্রধর সম্প্রদায়।
পাল-সেন আমলে দু একটি দারু ভাস্কর্যের নমুনা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।চ তুর্দশ শতকের দারু ভাস্কর্যের দৃষ্টান্ত বর্ধমান জেলার রায়না থানার বোড় গ্রামের বলরাম মূর্তি।প্রায় দশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বিচিত্র মূর্তি।মহাপ্রভুর জীবৎকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর দারুবিগ্রুহ। রাধা কৃষ্ণ বলরাম জগন্নাথ ছাড়াও মহাপ্রভুর ষড়ভুজ মূর্তি গৌরনাগরী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে।কাটোয়ার গৌরনাগরী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষোড়শ শতকের আটের দশকে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দাস গদাধর। গৌর নিতাই পঞ্চতত্ত্ব যবন হরিদাসসহ জাহ্নবা বিষ্ণুপ্রিয়া সীতা দেবী প্রমুখদের দারু মূর্তি বৈষ্ণবরা প্রতিষ্ঠা করেছেন মঠ মন্দিরেও গৃহে।শুধু বৈষ্ণব বিগ্রহ নয়,রামচন্দ্র সীতা লক্ষণ হনুমান কালী প্রভৃতি দারু বিগ্রহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দারুবিগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে সিজিন করা নিমকাঠ। কাটোয়ার মহাপ্রভুর নিমকাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল বাসু ঘোষের বাড়ি কুলাই থেকে।মূর্তিগুলি মূলত দেড়ফুট থেকে শুরু করে পাঁচ ফুটের মধ্য উচ্চতা বিশিষ্ট হয়।মূল কাঠ থেকে খোদাই করা হয় প্রস্তরবিগ্রহের মতো।
পাদপীঠ পদ্মবেদিকা।সমপাদস্থানিক,ত্রিভঙ্গিম ঠামে অথবা নৃত্যরত ভঙ্গিমায় একক মুর্তি দণ্ডায়মান।শায়িত বা বসা মূর্তি বিরল।পুরাতন মূর্তি গুলি প্রস্তর ভাস্কর্যের রীতি অনুসরণ করে খোদাই করা হলেও অনেক মূর্তির হাত পরে খিলান করে বসিয়ে নেওয়া হয়েছে।প্রথম দিকে ভাস্কররাই রঙের কাজ করতেন।পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রশ্রয় পাওয়াতে রঙের কাজ করেন ব্রাহ্মণশিল্পীরা।এদেরকেই বলা হয় অঙ্গরাগশিল্পী। আর বিগ্রহের রঙকরাকে বলা হয় অঙ্গরাগ বা অঙ্গসেবা।
অঙ্গরাগ ব্যয়বহুল বলে পাঁচ থেকে দশ বছর ব্যবধানে করা হয় ।প্রথমে মাটি চটিয়ে গঙ্গামাটির প্রলেপ দেওয়া হয়।তারপর শুকিয়ে নিয়ে একটা নতুন সাদা আদ্দির কাপড় নানা রকম আঁঠা সহযোগে এমন ভাবে পটি দেওয়া হয় যাতে তিল পরিমাণ ছিদ্র না থাকে।একে বলে হয় বস্ত্রসেবা।এরপর সাদাখড়ির প্রলেপ দিয়ে রঙের কাজ।চোখ আঁকা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।চোখ সাধারণত দীঘলপটল চেরা আকৃতির হয়।বৈষ্ণবমূর্তির কপালে অলকাতিলক এবং বনমালা আঁকা হয়ে থাকে অতি যত্নকরে।এই রঙের কাজ অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন লাগে বিগ্রহ অনুযায়ী।এই কয়েক দিন বিগ্রহের সেবা হয় মূর্তিকে উদ্দেশ্য করে।
অধিকাংশ ভাস্করের বাস ছিল কাটোয়া অগ্রদ্বীপ নবদ্বীপ বা শান্তিপুর এলাকার।কাটোয়া থানার বেড়া গ্রামের খ্যাতনাম অঙ্গরাগশিল্পী ছিলেন শীতল মহান্ত।তিনি দক্ষিণবঙ্গের মন্দির বা পারিবারিক বৈষ্ণব বিগ্রহগুলির অঙ্গরাগ করতেন।তাঁর মৃত্যুর পর সুযোগ্যপুত্র করুণাসিন্ধু গোস্বামী সেই ধারাটিকে বজায় রেখেছেন।করুণাসিন্ধুবাবু পেশায় শিক্ষক,মধ্যযুগীয় পুথিসংগ্রাহক।অবসরের সময় তাঁর ধ্যান জ্ঞান হলো এই দেববিগ্রহগুলির অঙ্গরাগ করা।নিজেদের পারিবারিক কানাই বলাই বিগ্রহ ছাড়াও কাটোয়ার গৌর,রাধাকান্ত,রাধামাধব ময়নাডালের মহাপ্রভু তথা বিভিন্ন জেলায় তিনি বৈষ্ণববিগ্রহের অঙ্গরাগ করেন।
Copyright ©UAA - 2024 all reserved.
BACK TO TOP