উনুন পুরাণ

স্বপনকুমার ঠাকুর

ছেলেবেলায় মোড়লের কোঁড়ল নিয়ে যখন সমস্বরে ছড়া কাটতাম তখন আচমকা রেগে গিয়ে মোড়ল খপ করে হাতটা ধরে বলতো -- শ্যালো তিন ফুঁয়ের বেঁড়ে বামুন! এবার ক্যা বাঁচাবে!

তখন অবশ্য ফুঁয়ের রহস্য ভেদ করা গোয়েন্দা হয়ে উঠিনি। পরে বেকার বাউণ্ডুলে জীবনে বুঝেছিলাম এই হতভাগা বামুনের আর কী হবে। ঐ কানে ফুঁ মানে গুরুগিরি। তার তো বাজার লকডাউন। শাঁখে ফুঁ দিয়ে পুজো আর্চায় এই শর্মা এক্কেবারে ঢ্যাঁরস। উনুনে ফুঁ দেওয়ার দিন শেষ। কেননা রান্নাঘর থেকে এমনিতেই শিল নোড়া বঁটি ঝুঁড়ি ঝাঁঝুড়ি ম্যায় হাতে পাতা আখা কবেই ফাঁকা। অথচ প্রথম যৌবনে গ্রাম্য বউঝিদের উনুনের মুখে লম্বা টিনের নল দিয়ে ফুঁ দেওয়ার সময় হাজির হলে দেখতে পেতাম ধূম্র কুণ্ডলীর বলয় রেখা বিনিন্দিত কুঞ্চিত অলকদাম শোভিত সহাস্য কৃষ্ণকলিদের কণ্ঠস্বর - এসো ঠাকুর পো।

মাইরি বলছি একাল হলে দুপুর ঠাকুরপো তকমা পেতে কতক্ষণ!

গতস্য শোচনা নাস্তি। অতএব, হাতে রইলো সেই উনুন। মানুষ যেদিন থেকে পাক বা রান্না করতে শিখেছে সেদিন থেকে চালের সঙ্গের চুলো এসে হাজির। মঙ্গলকোটের প্রত্ন খননে বিবিধ বস্তুর সঙ্গে উনুনও মিলেছে। মঙ্গলকোটের তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার প্রথম পর্বে খ্রিষ্ট পূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্ট পূর্ব ৬০০ অব্দের সময়সীমায় ঘর বাড়ির পুরা নিদর্শনের সঙ্গে তিন পাখার উনুন পাওয়া গেছে।

লোকভাষায় পাখা শব্দটির নানান অর্থ। যেমন মাটির বারান্দা কোঠা বাড়ির দাওয়ার চাল ধরে রাখার দুই পাশের দুই দেওয়াল হলো পাখা। এই কারণে এই ধরনের বাড়িকে পাখা পেড়ে বাড়ি বলে। আবার যে উনুনের একটি মুখ থাকলেও তিনটি উনুন বা আখা থাকে তার নাম তিন পাখা উনুন।

আসলে উনুন নানা ধরনের। তবে প্রথমেই দুটি ভাগে ভাগ করা ভালো। যেমন পাতা উনুন আর তোলা উনুন। তোলা উনুন মূলত আঁচের উনুন। গুল কয়লা এই উনুনের জ্বালানী এবং স্থানান্তর যোগ্য। বলা বাহুল্য এই উনুন বা আখা অর্বাচীনকালের হলেও নানা বৈচিত্রময়। বাজারে নানা আকৃতির এই উনুন এখনও পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলায় মায়েরা এই উনুন পাততেও বেশ দড়ো। আলুমিনিয়ামের বালতি, টিন, ফাটা লোহার কড়াই - কীসে না এই উনুন পাতা যায়।

দুপুরের অবসরের সময় বাড়ির গিন্নীদের উনুনপাতা ছিল এক সহজিয়া শিল্প। ভালো দোঁয়াশ মাটি দিয়ে তিনটি মাটির উঁচু ঝিঁক তুলে উনুন গড়ার কাজ চলতো। তবে একদিনে মাটি ধরানো যেতো না। পর পর দুদিন মাটি ধরিয়ে উনুনের কাজ সমাপ্ত হতো। উনুন কাড়া যেমন নৈমিত্তিক কাজ তেমনি গোবরজল দিয়ে নিকানো আরেকটি প্রাত্যহিক গৃহকর্ম।

এবার পাতা উনুনের কথা বলি। কাঠ বা ঘুঁটে আখের খোয়া, ধানের কুঁড়ো তিল সরষের খাড়া পাটকাঠি খড়ের উড়ুলি নারকেল তালপাতা জ্বালানি হিসাবে যে সমস্ত উনুনে ব্যবহৃত হয় সেগুলি এক পাখা থেকে শুরু দেড় পাখা বা দু পাখা বা তিন পাখা পর্যন্ত স্থির উনুন হয়। সেই উনুনপাতাও যর্থাথই একটি শিল্প।

প্রথমে প্রয়োজনীয় গর্তটুকু করে নেওয়া। তারপর মাটি ধরিয়ে ঝিঁক তোলার কাজ। রান্নার চালায় যখন একটি বড় এবং একটি ছোট মাপের এটাচ উনুন করা হয় তখন সেটি দেড় পাখার উনুন। এই উনুনে ভাতের সঙ্গে ডাল বা টক রান্না হয় একসাথে। দু পাখা বা তিন পাখা উনুন ধান সেদ্ধ করার জন্য আদর্শ। বাড়ির উঠোনের এক ধারে এই উনুন গড়া হতো। এক সাথে তিন হাঁড়ি ধান সেদ্ধ চলতে থাকে। আজ আর সেই উনুন গ্রামে খুব কম দেখা যায় কারণ ধান সেদ্ধ, মুড়ি ভাজার পাট কবেই লাটে উঠেছে।

আগে বিয়ে থা ভোজ কাজে ভিয়েনের উনুন তৈরি হতো। রান্নার চালের এক ধারে এই উনুন বানানো হতো। শুনুরে মুনিশ ছাড়া সেই উনুন গড়া অত সহজ জিনিষ নয়। গঠনের উপর নির্ভর করতো জ্বালের ব্যাপারটি। গুয়ে বাবলা বা সোনা বাবলার চেলানো শুকনো কাঠে দু দিন ধরে সেই উনুনে চলতো ভিয়েনের কাজ। রসগোল্লা পান্তুয়া কমলাভোগ আর দেদার বোঁদে তৈরি হতো গামলা গামলা। 

ভোজ কাজে এখনকার মতো সেসময় ক্যাটারারের আমদানি হয় নি। পাড়ার বউ ঝি যেমন বঁটি নিয়ে তরকারি কুটতে আসতো তেমনি লম্বা আয়তাকার আট ফুটের বিশেষ কায়দায় উনুন গড়ে ভাত রান্না করতেন পাড়ার লোকজনেরা। এই লম্বাটে উনুনকে বলা হতো জোলের উনুন বা আখা। এক সঙ্গে চার থেকে পাঁচ হাণ্ডা ভাত বসতো সেই উনুনে। ভাত হয়ে গেলে দু পাশে হাণ্ডার কানায় বাঁশ বেঁধে চলতো ভাত নামিয়ে মাড় গাড়ানোর কাজ। এখনও জোল উনুনের ব্যবাহার আছে গ্রাম গঞ্জের মোচ্ছব রান্নায়।

কত নামের যে উনুন ছিল তা বলে শেষ করা যায় না। যেমন আঁচের উনুন, তোলা উনুন, ভাতের উনুন, ধান সেদ্ধর আখা, চায়ের উনুন, ইত্যাদি। খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরির উনুন  চৌকো বা আয়তাকার। এর কড়াইও তেমনি। এ উনুন তেমন কিছু আহামরি নয়। তার থেকে বড় ধান সেদ্ধর তাপাল উনুন তৈরি করা বেশ কষ্ট সাধ্য। তবে এসব উনুন পুরুষালি হাতের তৈরি। কমনীয়তা কম। এবার একটি আদিকালের উনুনের কথা বলব। সে উনুন পুরুষের হাতে তৈরি হলেও বিশেষ বৈচিত্র্যময়।

রাঢ় বাংলায় যাঁরা আখের গুড় তৈরি করা দেখেছেন তাঁরা সেই উনুন চাক্ষুস করেছেন  আশাকরি। আখের গুড়ের উনুন প্রায় দশ হাত লম্বা। চওড়া কম করে পাঁচ থেকে চার হাত। প্রায় চার ফুট গর্ত করে সেই উনুন জোলের মতো কাটা হয়। সামনের দিকে এক ফুট ফোঁকর রেখে প্রায় চার ফুট উঁচু করে মাটির দেওয়াল দেওয়া হয়। পিছনে ধোঁয়া বের হয় ছয় ফুট লম্বার একটি মাটির বৃত্তাকার চোঙা থেকে। ভিতরে বসে দুটি  বড় লোহার কড়াই।এবার মাটি দিয়ে ফাঁক ফোঁকর বুঁজিয়ে দেওয়ার পালা। 

রসে জ্বাল দেয় ফোঁকর দিয়ে শুকনো আখ পাতা অর্থাৎ আলসে দিয়ে। রস তেতে ওঠে। ক্রমশ রসের ময়লা তুলে ফুটন্ত রসের ফুট আসে। সেইসব রসের ফুট নানা নামে চিহ্নিত যেমন মুসুরি ফুট, দানা ফুট, গুড় ফুট, ইত্যাদি। গুড় বাড়ুই খেজুরপাতার ঝাঁপ মেরে যখন ফুটন্ত রসকে বাগে আনার চেষ্টা করতো তখন তালপাতার সবুজ শিরে আলুর ফালি করে কাটা চাকতির মালা নিয়ে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে থাকতাম গুড় বাড়ুইএর মর্জির উপর। এই রসের আলু যে খেয়েছে সেই জানে এর কী স্বাদের মহিমা। 

 

BACK TO TOP