কুমোরের চাক পুজো

স্বপনকুমার ঠাকুর

কুমোর বা কুম্ভকার বাংলার অতি প্রাচীন এক জনজাতি। এরা শুধু ভূমিপুত্র নন,মাটির সঙ্গে আদ্যোপ্রান্ত জড়িয়ে আছেন। ইতিহাস বলে নব্যপ্রস্তরযুগ থেকে মাটির তৈরি বাসন কোসন নির্মিত হচ্ছে। প্রথম যুগে হাতে তৈরি হতো হাঁড়ি কুড়ি ।পরে চাকা বা চাক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মৃৎশিল্পের যুগান্তর আসে।

চাকা বা চাককে সংস্কৃতে কুলাল বলা হয়।ঐতিহাসিকেরা এই মৃৎসভ্যতাকে কৌলাল সভ্যতা বলেছেন।লাল কালো ,কালো ধূসর বাদামি ইত্যাদি বর্ণের মাটির তৈজসপত্রাদির প্রাচীন নিদর্শন হরপ্পা সভ্যতা তথা প্রাচীন তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার স্মারক বিশের সকল প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে।বাংলায় পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে চন্দ্রকেতুগড় মঙ্গলকোট ও অন্যান্য স্থান থেকে পর্যাপ্ত মাটির পুরাসম্পদ পাওয়া গেছে।

টেরাকোটার দেশ বাঁকুড়া।বিশেষকরে পাঁচমুড়ার নাম প্রায় সকলেই জানেন টেরাকোটা কাজের জন্য।এখানে প্রায় সত্তরটি পরিবারের কয়েকশো মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত।এখানকার চাকপুজো বিখ্যাত।সারা বৈশাখ মাস এখানে কুমোরের চাক বন্ধ থাকে। তৈরি হয় না কোন ধরণের মাটির জিনিসপত্র। দীর্ঘ এক মাস বিশ্রামের পর জ্যৈষ্ঠ মাসের কোন এক বিজোড় শনিবারে কুমোরের চাকাতে বিশেষ পুজা পাঠের মধ্য দিয়ে নতুন করে শুরু হয় মাটির কাজ।

পুজোর দিন কুমোরপাড়ায় সাজো সাজো রব।খুব সুন্দর করে চাকটিকে সাজানো হয় ফুল রঙ্গোলি আর বিচিত্র আলপনায়।পুজো করতে আসেন কুলোপুরোহিত।পুজোয় নানা  ফল মিস্টান্ন আতপ চালের নৈবেদ্য সহ পদ্মফুল লাগে।আনন্দে উৎসবে মত্ত হয়ে ওঠে কুমোরপাড়া।

চাকপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নারায়ণ ও শিবের প্রসঙ্গ।বিষ্ণু বা নারায়ণের প্রধান আয়ুধ হলো চক্র। একাংশের মতে চাক ঘোরানো লাঠি আসলে শিবের ত্রিশূল।অধিকাংশের মতে চাকাটি আসলে গৌরীপট্ট।এর মাঝে থাকে শিবলিঙ্গ।পাঁচমুড়ার বাসিন্দা মৃত্‍শিল্পী তাপস কুম্ভকার বলেন,"চৈত্র মাসের ২৮ তারিখে চাকাটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তার মাথায় বেশ কিছুটা মাটি বসিয়ে এক পাক ঘোরানো হয়। এভাবে ঘোরার ফলে ওই মাটি একটি শিব লিঙ্গের আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় পুরো বৈশাখ মাস রেখে দেওয়া হয়।পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের এক বিজোড় শনিবার সেই শিব লিঙ্গের আকৃতি বিশিষ্ট মাটিকে সুন্দর করে সাজানোর পর কুলপুরোহিত ডেকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পুজো করা হয়।পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

কুম্ভকার চাক নিয়ে অসাধারণ লোকপুরাণের গল্প রয়েছে।একবার শিবের গাজনের সময় শিব অনুপস্থিত ছিলেন। এদিকে বৈশাখমাসে কর্মরত কুম্ভকারদের চাকায় এসে উপবেশন করেন দেবাদিদেব মহাদেব।কুম্ভকাররা সেই থেকে চাকাকে মহাদেব জ্ঞানে পুজো করতে থাকেন।

 

BACK TO TOP