জামালপুরের বুড়োরাজ

স্বপনকুমার ঠাকুর

বৈশাখী পূর্ণিমা।হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন।এই পবিত্র তিথিতে ভগবান বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন।এই দিনেই তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। আবার এই পবিত্র দিনেই তিনি মহাপরিনির্বাণের পথে অমৃতলোকে পাড়ি দেন।বৈশাখী পূর্ণিমায় গন্ধবণিকগণ তাঁদের আরাধ্য দেবী গন্ধেশ্বরীর পূজার্চনায় মত্ত হন। পূর্ণচন্দ্রালোকিত রাত্রিতে কোথাও কোথাও  পালিত হয় শ্রীকৃষ্ণের ফুলদোল উৎসব।আর এই দিনেই রাঢ়-বাংলায় গ্রাম-গ্রামান্তরে ধর্মরাজের গাজনে  ঢাক-কাঁসির বাজনায়  প্রান্তীয় লোকসমাজ আনন্দে মেতে ওঠেন।বিশেষকরে বর্ধমানজেলার জামালপুরে অগণিত  আবালবৃদ্ধবণিতা বুড়োরাজের গাজনে সমবেত হন।

 লোকপ্রিয় বুড়োরাজ। শিব আর ধর্মরাজের এক বিচিত্র মিশ্র লোকদেবতা।বুড়ো মানেই বৃদ্ধ,আদি।তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। কবি ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন--"অতিবড় বৃদ্ধপতি সিদ্ধিতে নিপুণ"। রাজ মানেই ধর্মরাজ। ধর্মরাজের পুজোর সন্ন্যাসী বা পদাধিকারী নামের মধ্যেই  নিহিত রয়েছে প্রাচীন রাজতন্ত্রের এক ধূসর আবহ ; যেমন ধর্মরাজের গাজনে অনেক সন্ন্যসারীর নাম কোঙরস্বামী (কুমারস্বামী),যুবরাজ,উঠাসিনী(ঔত্থায়াসনিক),ধামাৎকর্ণি(ধর্মাধিকরণিক) ইত্যাদি।এই নামগুলি প্রাচীন হিন্দুরাজার পরিকর বা সভাসদদের স্মৃতিবাহী। তবে যাই বলুন ধর্মরাজ ভিখারিরাজা। তিনি থাকেন গাছতলায়। মাটির কুটিরে।নামমাত্র তাঁর পূজার উপকরণ।আর ভিখারি রাজা বলেই ধর্মরাজ সহজেই মিশে যান নীলকণ্ঠ শিবের সঙ্গে।  কেননা শিব নিজেই ভিখারি।

 এহো বাহ্য।অনেকেই ধর্মরাজকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধধর্মের প্রতিভূ বলে বর্ণনা করেছেন।বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে ধর্মরাজের গাজন বলে শুধু নয়,শূন্যমূর্তি ধর্মঠাকুর এবং শূন্যাকার ধর্মশীলা শূন্যবাদী বৌদ্ধদের প্রভাবসঞ্জাত বলে অনেকেই দাবী করেন।যদিও ধর্মরাজ সংশ্লিষ্ট 'নিরঞ্জন' ও 'শূন্য' শব্দের অর্থ নিষ্কলঙ্ক নির্লেপ।তাই তিনি  শ্বেত-শূভ্র উলুক বাহন ধবলমূর্তি।আসলে বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী ছিল মর্যাদা সূচক সন্ন্যাস পদ। থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে সাধুদের ভিক্ষু বলা হতো। ভিক্ষালব্ধ অন্নে তাঁরা প্রতিপালিত হতেন।ধর্মরাজপুজোর অন্যতম অঙ্গ হলো- সন্ন্যাসীদের ধর্মশীলা নিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে ভিক্ষা করা।এই দিক থেকে ধর্মরাজপুজোর সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের আশ্চর্য মিল দেখা যায়।জামালপুরের বুড়োরাজের সন্ন্যাসীরাও ত্রয়োদশীর দিনে গ্রাম পরিক্রমা করেন।

গাজন --এক বিশেষ ধরনের ব্রত-কৃত্যাদি। হিন্দুদের মূলপুজোবিধির সঙ্গে এর বিস্তর পার্থক্য।দৈহিক কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসীরা অভিষ্ট পূরণের লক্ষ্যে শিব বা ধর্মরাজের আরাধনা করেন।শিবের গাজনের বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায় বৃহদধর্ম উপপুরাণে আর ধর্মরাজের গাজনের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণে।উভয় গাজনে প্রকরণগত  মিল থাকলেও অমিলও কম নেই।শিবগাজনে ভাঁড়ালপোরা নেই।ধর্মরাজের গাজনে পশুবলি,স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষধ দান,শালেভর দেওয়া ইত্যাদি  থাকলেও চড়ক নেই।জামালপুরের বুড়োরাজের গাজনে এই দুয়ের এক আশ্চর্য সহাবস্থান লক্ষ করা যায়।বুড়োরাজের মূল পুজোয় এই কারণে মূল নৈবেদ্যটি দু ভাগে ভাগ করা ।একভাগ শিবের নামে অপরভাগটি ধর্মরাজের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়।শিব ও ধর্মের এই মিশ্রদেবতার "বুড়োরাজ কাল্ট" রাঢ়বাংলায় অনেক ধর্মরাজ গাজনে লক্ষ করা যায়।

হাওড়া-ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া রেলপথের পাটুলি স্টেশন।এখানে নেমে অটো-টোটো-ভটভটিতে চেপে সোজা জামালপুরের বুড়োরাজের থান। জামালপুর এমনিতে তপশিলী অধ্যুষিত ছোট্ট জনপদ। সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে বাবার মন্দির।চৌরি মেঠো ঘর। দাওয়া উঁচু ঘরে খড়ের চাল।প্রশস্ত নাটমন্দির।অদূরে পশুবলির জন্য হাড়িকাঠ।পাশেই ভক্তরা মানতপূরণের লক্ষে গাছে বেঁধে দিয়েছেন অগুনতি মনস্কামনার ঢিল।মন্দিরের বাইরে সারিবদ্ধ দোকান,ফলমূল পুজোর উপকরণ বিক্রি হচ্ছে দেদার। নিত্যসেবা হয়।সোমবারে ভিড় জাঁকিয়ে ওঠে।দিনটি 'বুড়োরাজের বার' বলে ঘোষিত।গর্ভগৃহে বাঁশের পার্টিসন দিয়ে ঘেরা বাবা বুড়োরাজের  স্থানটি।মাটিতে নিমজ্জিত অনাদি শিবলিঙ্গ।এখানেই ভক্তরা পুজো দেন।পূর্বে বুড়োরাজের সেবাইত-পুজারি ছিলেন গ্রামের চট্টোপাধ্যায় বংশ।পরে দৌহিত্র সূত্রে বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ বাবার সেবাইত-পূজারি।

জামালপুরের বুড়োরাজের আবির্ভাবের কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকর।বহু পূর্বে গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো গঙ্গার শাখা কৌমারি নদি। সে সময় নদির তীরে ঘন জঙ্গল।পাশের গ্রাম নিমদহ।সেখানকার  ধনাঢ্য যদু গোয়ালার গরু মোষের পাল জামালপুরের জঙ্গলে চরতো।যদুর শ্যামলী নামে একটা   দুধেল গাই ছিল।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শ্যামলীর দুধ পাওয়া যেত না।ঘোষ মশাই তক্কে তক্কে থাকেন।কে তার গরুর দুধ দুয়ে নেয়।চোরকে হাতেনাতে ধরতে হবে।গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে যদু যা দেখলো তাতে তার চক্ষু ছানাবড়া।একটা পাথরের উপর শ্যামলী পরম তৃপ্তিতে দুধ দিচ্ছে।রাত্রে স্বপ্ন দেখলো।এক পরমপরুষ যেন জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বলছেন-- "যদু...ওরে আমি বুড়োরাজ।আমার পুজোর ব্যবস্থা কর।"যদু নিরক্ষর গোয়ালা।ছুটে গিয়ে জামালপুরের শিবভক্ত চ্যাটুজ্জ্যেমশাইর কাছে সব কথা খুলে বলতেই ঠাকুরমশাই জানালেন-- "যদু! বাবা তোকে কৃপা করেছেন।"সেই থেকে বুড়োরাজের পুজো শুরু। প্রথম পুজোর দাবিদার সেই যদুগোয়ালার বন্দশধরদের।বর্তমানে  যদুর বংশ লোপ পেলেও  নিমদহ গ্রাম থেকে বড় বড় মই সাজিয়ে পুজো আসে সর্বাগ্রে।বলাবাহুল্য রাঢ়বঙ্গের অধিকাংশ অনাদি শিবলিঙ্গের আবির্ভাবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এই গল্পটি।সন্দে নেই,আদিতে বুড়োরাজ ধর্মরাজ রূপেই পূজিত হতেন।পরে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে তিনি শিব রূপে পূজিত হতে থাকেন।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও তাই মনে করতেন।শাস্ত্রী মহাশয়ের শ্বশুরবাড়ি জামালপুরের অনতিদূরে দেয়াসীন গ্রাম।এখান থেকে তিনি একাধিকবার  বুড়োরাজের থানে গিয়েছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তু সংগ্রহ করেছিলেন।

বুড়োরাজের ব্রত পালন একবছরের।সোমবার বাবার বার।দুরারোগ্য ব্যধি,সন্তানহীনতা,যক্ষা,অম্লশূল,কঠিন সমস্যা ইত্যাদির প্রতিকারের জন্য অনেকেই এই ব্রত  পালন করেন।বারো মাসে বারোটি শক্লপক্ষের সোমাবারে এই ব্রত পালনের বিধি।পারণ চলাকালীন এক বছর  মাংস পিঁয়াজ গুগুলি ডিম খাওয়া নিষিদ্ধ।বাৎসরিক উৎসব বৈশাখী পূর্ণিমায়।একমাস আগে থেকে মুল সন্ন্যাসীর কামান।সেদিন থেকে তিনি হব্যিষান্ন করেন।সাত দিন আগে সাতের কামান।এই দিনে অগণিত ভক্ত বাবার থানে গিয়ে ব্রাহ্মণের কাছে নিজ গোত্র পরিত্যাগ করে বুড়োরাজের গোত্র গ্রহণ করেন।পাঁচ দিন আগে পাঁচের কামান।এই দিন ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে বাবার বার করেন।সাতের কামানের সন্ন্যাসীরা মহাহব্যিষি করেন।মাটির মালসায় শুধুমাত্র তিনটি চালের কনা ফুটিয়ে একটি প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করে বাকি দুটি মালসা ও খাবার পাত্রে রাখতে হয়।

পাঁচের কামানের দিন থেকে শুরু হয়ে যায় উত্তরীয় গ্রহণের পালা।ত্রয়োদশীতে ফলদান।চতুর্দশীর দিনে বাবার নামে বান ফোঁড়ার প্রথা।পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু হয় মহাপুজো। এই দিন হাজার হাজার পশুবলি হয়।তবে মন্দির প্রাঙ্গণে বলি হয় না।পূর্বে পশুবলিকে কেন্দ্র করে পাঁঠা কাড়াকাড়ির রেওয়াজ ছিল।লোকবল কম দেখলে সুযোগ পেলেই বলবানেরা পাঁঠা কেড়ে নিয়ে পালাতো।বর্তমানে সেই আদিমপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।মহাপুজো উপলক্ষে বাবার থানে বিশাল মেলা বসে।পূর্বে এই মেলা এক মাস চলতো।মেলায় সার্কাস,পুতুলনাচ থেকে নানা ধরনের দোকান পাটে সরগরম হয়ে ওঠে।বর্তমানে মেলার পূর্বের জৌলুস অনেকাংশে শিথিল হয়েছে।

জমালপুরের মেলা উপলক্ষে প্রচুর মানুষের সমাগমের পাশাপাশি অস্ত্র এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র  নিয়ে অনেকেই শোভাযাত্রা সহকারে আসতেন।এর পিছনে ছিল একটি দুর্ঘটনা। ১৯৪৬ সালে মেলা চলাকালীন একবার হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা বাদে মেলা প্রাঙ্গণে।প্রচুর দোকান লুঠ হয়ে যায়।একদল উন্মত্ত দুষ্কৃতি বাবা বুড়োরাজের মন্দিরে আগুন ধরাতে গেলে অতর্কিতে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে আসে। বাবার অলৌকিক কেরামতি ভেবে দুষ্কৃতিরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।সেই থেকে মেলায় আসার সময় আত্মরক্ষার জন্য রামদা তরোয়াল নিয়ে দলবেঁধে লোক জমায়েত হয়।বর্তমানে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এই প্রথা বহুলাংশে শিথিল হয়েছে।

আগণিত ভক্ত তাদের প্রাণের দেবতার কাছে অভীষ্ট পূরণের জন্য কেউ হত্যে দেয়,দণ্ডীখাটে,ধুনো পোড়ায়। দেশ-দেশান্তর থেকে বাবার টানে কত জন ছুটে আসে।সাধু সন্ন্যাসীর জমায়েত হয়। প্রচণ্ড দাবদাহ আর  কালবৈশাখীর তাণ্ডবকে উপেক্ষা করে অগণিত  সাধারণ মানুষ বাবার নামে জয়ধ্বনি করে-- জয় বুড়োরাজের জয়! জয় বুড়োরাজের জয়!!

 

BACK TO TOP