জগদানন্দপুরের রাধাগোবিন্দ মন্দির

স্বপনকুমার ঠাকুর


পূর্ববর্ধমান জেলার পাথরের মন্দির বলতে জগদানন্দপুরের রাধাগোবিন্দ মন্দির।দোতালা চুড়াবিশিষ্ট ইঁট ও  পাথরের অলঙ্কৃত  ব্যতিক্রমী মিশ্ররীতির মন্দির।যার সৌন্দর্যের টানে আজও পর্যটকরা ভিড় করেন এই গ্রাম্যমন্দির প্রাঙ্গণে।

কাটোয়া-কালনা ঝাঁ-চকচকে বাসরাস্তার  ধারে জগদানন্দপুর বাসস্ট্যান্ড। দক্ষিণমুখো  মিনিট চারেকের হাঁটা পথে  পৌঁছানো যাবে প্রশস্ত মন্দির প্রাঙ্গণে।প্রায় ৮২ ফুট উঁচু আকাশ ছোঁয়া মন্দিরচূড়া। পঞ্চাশ শতক জমি জুড়ে  ইট-পাথরের এই মিশ্ররীতির অলঙ্কৃত মন্দির।প্রবেশপথের তোরণের উপরে  ইস্টক নির্মিত হরগৌরী দেবালয়। এটিও দ্বিতল দালান রীতির মন্দির।মাথায় ইসলামিক স্থাপত্যের গম্বুজের শোভা।

এই মন্দির তৈরি করেছিলেন প্রস্তরমন্দিরের রূপকার রাধামোহনেরপুত্র মধুসূদন ঘোষ চৌধুরি।পশ্চিমমুখী গর্ভগৃহে হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি।দেওয়ালে খোদিত পাথরের প্যানেলে দশাবতার চরিত্র।প্রবেশ পথের পাশে সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় ওঠা যায়।পূর্ব পশ্চিমে প্রসারিত লম্বা  একটা বারান্দা মূল  প্রস্তরমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত।

  প্রস্তরমন্দদিরের দোতালায় শীতকালে  আগে পুজো হতো । বিগ্রহ সেবার জন্য আটকোনা বেদির সম্মুখে কষ্টিপাথরের রাসমঞ্চটি আজও রয়েছে।এখানে আছে অষ্টসখির প্যানেল।পাশ দিয়ে নেমে গেছে সিঁড়ি।এবার  নীচে মূলমন্দিরের গর্ভগৃহ।কৃষ্ণলীলার বিচিত্র আলেখ্য খোদিত। দরজার মাথায় গজলক্ষ্মী মুর্তি। অলিন্দের প্যানেলে নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী।বিগ্রহ বলতে মহাপ্রভু এবং রাধা গোবিন্দ জিউ।সঙ্গে পূজিত হচ্ছেন কুলদেবতা দামোদর শিলা ও যশোর থেকে আনা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ।

নিচের নাটমন্দিরের স্তম্ভে খোদিত বিচিত্র প্যানেল।মুখ্য বিষয়--কৃষ্ণলীলা,চৈতন্যলীলা ও পুরাণের জনপ্রিয় কাহিনি যেমন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন,কৃষ্ণের জন্মলীলা ,মহাপ্রভুর নীলাচলে রথযাত্রায় সপার্ষদ নৃত্য্,রাম রাবণের যুদ্ধ ,সিংহবাহিনীদুর্গা  এবং  জনপ্রিয় নরনারীর কুঞ্জর মূর্তি।রাধা একবার কৃষ্ণের সঙ্গে রসিকতা করার জন্য আটজন সখীসহ নিজে হাতির মতো সজ্জিত হয়েছিলেন।কৃষ্ণ ভ্রম করে হস্তীবধ করতে উদ্যত হলেন। সখীদের হাস্যকলরোলে কৃষ্ণের ভ্রম ভাঙে।এই দৃশ্যটি পরবর্তীকালে দারুন জনপ্রিয় হয়েছিল শুধু মন্দিরফলকে নয়; ছাপা বইয়েও।

 মূলমন্দিরটির গঠনের দিক থেকে বেশ অভিনব, পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট।  রথাকৃতি এই মন্দির। মূলচূড়ায় খোদিত জগন্নাথের রথচিত্র ও চতুর্ভূজ নারায়ণ মূর্তি। কার্নিশে নানা মূর্তির অলংকরণ।সমগ্র মন্দির পরিকল্পনায় শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব ধর্মের মহা সমন্বয়ের বার্তাটি প্রকাশিত।

মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চৈতন্য পার্ষদ  কুলাইগ্রামের পদকর্তা বাসু ঘোষের অধস্তন বংশধর রাধামোহন ঘোষ চৌধুরি। জ্যোতির্ময় ঘোষ চৌধুরির লেখা 'মন্দিরের স্থাপনা বিবরণ' থেকে জানা যায়--রাধামোহনের পিতা কৃষ্ণদুলাল ঢাকায় নবাবের সামান্য কর্মচারী থেকে কর্ম দক্ষতার গুণে যশোরের রামনগরে তালুকদারি ও চৌধুরি খেতাব  পেয়েছিলেন।পরে নীলকুঠি কিনে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠেন।একসময় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুনজরে পড়ে যশোরের কালেকটর নিযুক্ত হন কৃষ্ণদুলাল।রামনগরে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে একমাত্র পুত্র রাধামোহনকে জন্মভূমি জগদানন্দপুরে  এই লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ'র মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলে যান ।

শতাধিক বৎসর পুর্বে রচিত নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত কাটোয়ার ইতিহাসে (সম্পাদনাঃ স্বপনকুমার ঠাকুর) জগদানন্দপুর শীর্ষক রচনাটি থেকে জানা যায় এই ব্যতিক্রমী মন্দিরটির ভিত খনন করেছিলেন  স্বয়ং কৃষ্ণদুলাল ঘোষ ১২৪৬ সালের আষাঢ়মাসের শুক্লপক্ষ দশমী তিথি,সোমবারে।অতর্কিতে তিনি প্রয়াত হন।তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন সুযোগ্য সন্তান  রাধামোহন ঘোষ।শ্রীচট্টোপা্ধ্যায়ের  মতে বহুলোকের পরিশ্রমের ফলে এগারো বৎসর ধরে ১২৫৭ সালে প্রস্তরমন্দিরের কাজ শেষ হয়।আরও দুবছর পরে নাটমন্দির ও শোভামন্দিরের কাজ সম্পন্ন হয়।

 অনেকেই বলেন বৃন্দাবনে লালাবাবুর মন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে রাধামোহন  জগদানন্দপুরে এই মন্দির নির্মাণ করেন।।উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে  প্রয়োজনীয় পাথরগুলি ভাগীরথী নদি  ও   স্থানীয় সপুলা-মপুলানদির প্রবাহ পথে নিয়ে আসেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে  দক্ষ শিল্পীদের ও দাঁইহাটের খ্যাতিমান ভাস্করদের  সহায়তায়  সুদীর্ঘ সময় ধরে মন্দিরের কাজ নিস্পন্ন করেন প্রভুত অর্থ ব্যয় করে। দুর্ভাগ্যবশত  শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ প্রস্তরমন্দিরের দোতালার নাটমন্দির ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে।সেই থেকে দোতালায়  দেবসেবা বন্ধ হয়ে যায়।

 রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরের নিত্য সেবা ছাড়াও  কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ,রাধাষ্টমী্ঝুলনযাত্রা ও অন্নকূট উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়।তবে দোল-হোলি উৎসবই মুখ্য।শুধু জগদানন্দপুর নয়;আশেপাশের একাধিক গ্রাম রাধাগোবিন্দের দোলযাত্রাকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে আনন্দে।দোলের আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় বর্ণাঢ্য অধিবাস দিয়ে শুরু।দোলের দিন ও রাত অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন।পরের দিন কীর্তন কবিগান যাত্রাভিনয় বাউলগান ইত্যাদি  বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।পঞ্চম দোলে গ্রাম প্রদক্ষিণ ,ধূলোট এবং আবির খেলা।শেষে মচ্ছোব-প্রসাদ গ্রহণ ।এই উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে জমজমাট মেলা।নাট মন্দির প্রাঙ্গণে পুতুল সজ্জার মধ্য দিয়ে রাধা কৃষ্ণের দোল যাত্রাকে প্রদর্শন করা হয় যা  দেখার টানে অসংখ্য দর্শনার্থীর  আজও সমাগম হয়।

 

BACK TO TOP