ভূতের পালকি

স্বপনকুমার ঠাকুর

তেপান্তরের হুদোসখানা মাঠ। কেউ কোত্থাও নেই। সাঁজ নামছে মাঠটি জুড়ে। শিয়ালদের হুক্কিহুয়া। ঝাঁকড়া গাছের মাথায় মাথায় জোস্তাপোঁকার ঝিকিমিকি। ঐ শোনা যায় কাহারদের ডাক -- হুম হুনা রে হুম হুনা...

পালকি আসছে মাঠাল পথ-আল ভেঙে ভেঙে। এবার ডহরে উঠবে। ভাবছেন এবার নিশ্চয় রঘু ডাকাতের দল হা রে রে রে করে মাঠ ফাটিয়ে ডাক দেবে। হাতে তাদের জ্বলন্ত মশাল। আর তারপরই রুদ্ধশ্বাস ডাকাতি। 

কিন্তু সে গুড়ে বালি! পালকির দিকে একটিবার তাকান। আপনার রক্ত হিম হয়ে যাবে।

ভূত দম্পত্তি। অমাবস্যার আঁধার মাখানো দেহ। চোখগুলো ভাঁটার মতো জ্বলন্ত। ভূত গৃহিনীর কপালে চওড়া সিঁদুর।

ভাবছেন গাঁজাখুড়ি গপ্পো। কিন্তু বিশ্বাস করুন এমন লোকবিশ্বাস জড়িয়ে আছে আমাদের বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভূতচতুর্দশী উপলক্ষে হাওড়া জেলার গ্রামে গঞ্জে। বিশেষ করে  ব্রাহ্মণ- কায়স্থবাড়ির লোকাচারে। ভূতের পালকি করে যমালয় থেকে ভূতদম্পত্তির মর্ত্যে আগমন হবে বামুন কায়েতের বাড়িতে। আর সেই লোকবিশ্বাস জীবন্ত হয়ে এক বিচিত্র আলপনার মধ্য দিয়ে।

অতীতকে স্মরণ ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ভারতীয় তথা বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম মূল সুর। এই কারণে মহালয়ের দিন খাদ্য ও জল নিবেদন করা হয় পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে। কালী পূজার আগের দিন অর্থাৎ ভূতচতুর্দশীর সন্ধ্যায় দীপ দেখানো হয় তাঁদেরকে স্মরণ করে।

ভূত চতুর্দশীর বিশেষ লোকাচার হল গেরস্থ বাড়িতে দুপুরে চোদ্দশাক খাওয়া। সন্ধ্যায় চোদ্দপুরুষের উদ্দেশ্যে চোদ্দপ্রদীপ জ্বালানো আর ভূতের পালকি আঁকা। হাওড়া জেলায় মূলত ব্রাহ্মন ও কায়স্থ সম্প্রদায়ের বাড়িতে ভূতচতুর্দশীর সন্ধ্যায় রান্নাঘর, গোয়াল, শোওয়ার ঘরের দরজার দুপাশে চালবাঁটা দিয়ে এই আলপনা আঁকেন বাড়ির গৃহিনী ।

পালকির মধ্যে থাকেন ভূতদম্পতি। স্ত্রী ভূতের কপালে চওড়া করে সিঁদুর আঁকা।  পালকি বহন করে চারটি ভূত। লোকবিশ্বাস হলো এই রাতে প্রয়াত কর্তা-গিন্নিরা তাঁদের জীবিত  বংশধরদের দেখতে আসেন।

তাদের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আর্শিবাদ করেন। পরের দিন সকালে গোবর জল দিয়ে ঐ আলপনা মুছে ফেলেন বর্তমান গিন্নিরা। 

 

BACK TO TOP